মেয়েদের ঘর সংসার এর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে দেবী দুর্গার ইতিকথা
মৃত্যুঞ্জয় সরদার, কলকাতা: এই বছরটা মানুষ সম্পদের জন্য তেমনি কোন উন্নতির দিক দেখতে পাইনি। ভগবান চিরকালই ধ্বংসলীলায় মেতে থাকে না, অতিষ্ঠ হয়ে গিয়ে তিনি ধ্বংস করে দিচ্ছে এই পাপীতাপী মানুষগুলোকে। এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। মানবের চিরকাল একটি ধর্মে বিভোর অন্ধকারে ডুবে রয়েছে । যখন আমরা কোনো কিছু যুদ্ধে পারদর্শী হতে পারি না, তখন ভগবানের দায়ী দিয়ে নিজে দায় সাড়ি। দুই হাজার কুড়ি সাল মানে দুটো বিষ বিষ এর বিষয় হচ্ছে এ বছরে বিষে বিষক্ষয়। এই সালটা ২০২০ তাই বিষে বিষক্ষয় হচ্ছে মানবসম্পদ!এবছরে কোন কিছুতেই যেন শুভদীক দেখতে পাচ্ছি না। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুশয্যায় আজ লড়ছে। তবুও বিশ্ব সংস্কৃতির মেলবন্ধন ও উৎসব পালন করছে ভক্তি যোগের ঈশ্বর ভক্ত মানুষগুলো।
এখন যেন একটা কেমন অরাজকতা এসে গেছে, সবকিছুর মধ্যে যেন রাজনীতির রং দেখছে। তবে তৎকালীন পুজো বা উৎসবের মধ্যে রাজনৈতিক রং এর কোন মিল বন্ধ ছিল না।পুজো বা দুর্গা দেবী আরাধনার পিছনে পৌরাণিক ইতিকথার ঐতিহাসিক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রমাণ রয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে নিজে গবেষণা করে তারপর আমি আপনাদের সামনে পরিবেশন করছি সেই তথ্য।হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও সামাজিক উত্সব হল দুর্গাপুজা বা দুর্গোত্সব। হিন্দু দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করেই এই মহোত্সব। শাস্ত্রীয় বিধান মতে, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গোত্সব পালন করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এই পুজাকে শরৎকালের বার্ষিক মহা উৎসব হিসাবে ধরা হয় তাই একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের ২য় দিন থেকে ৭ম দিন পর্যন্ত এই উৎসবকে মহালয়া, মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও মহাদশমী নামে পালন করা হয়।
রামায়ণ অনুসারে, অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে বসন্তকালের দূর্গা উৎসবকে বাসন্তী পূজা বা অকালবোধনও বলা হয়। শারদীয় বা অকাল বোধন পূজা এবং বাসন্তী পূজা দুই পূজা কিন্তু দুর্গাপুজো। একটা বসন্তকালে হয়েছিল ,আরেকটি শরৎকালের রামচন্দ্র অকাল বোধন পূজা করেছিল।সেই ইতিহাস আজ আমি আমার কলমে তুলে ধরছি।দুর্গাপূজা হল বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসব। প্রচলিত কথা অনুযায়ী বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন রাজা সুরথ। মেধস মুনির কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে মেধসাশ্রমে তিনি এবং বৈশ্য সমাধি বাংলা তথা বিশ্বে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন। সেই থেকে এই পুজো আজও হয়ে আসছে।
বাসন্তী পূজা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। রাজা সুরথ বসন্তকালে প্রথম দুর্গাপূজা চালু করেছিলেন,তাই এর আরেক নাম বাসন্তী পূজা। মর্ত্যে দেবী দুর্গার প্রথম পূজারী হিসাবে চন্ডীতে রাজা সুরথের গল্প উল্লেখ করা আছে। জেনে নেওয়া যাক প্রচলিত সেই কাহিনী। রাজা সুরথ সুশাসক ও যোদ্ধা হিসাবে বেশ সুখ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশের। জীবনে কোনো যুদ্ধে তিনি পরাজিত হননি। কিণ্তু সুরথ রাজার প্রতিবেশীরাজ্য (যবন রাজ্য) তার প্রতি হিংসাত্মক মনোভাবসম্পন্ন ছিল। যবন রাজ্য একদিন সুরথ রাজার রাজ্যকে আক্রমণ করে এবং তাদের কাছে সুরথ রাজের পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তার (সুরথ )রাজসভার মন্ত্রী, ও অন্য সদস্যরা সব ধনসম্পত্তি লুঠ করে। কাছের লোকেদের এমন আচরণ দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে যান। অবশেষে সর্বহারা হয়ে বনে আশ্রয় নেন। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধাঋষির আশ্রমে হাজির হন।
ঋষি রাজার সমাদর করে তার আশ্রমে থাকতে বলেন। আশ্রমে থেকেও রাজার মনে কোনো শান্তি ছিল না। তিনি সবসময় হারানো রাজ্য ও তার প্রজাদের ভালো-মন্দের কথা চিন্তা করে অস্থির হতেন। বনের মধ্যে একদিন সুরথ রাজার সমাধি নামে একজনের সাথে দেখা হয়। তার সাথে কথা বলে সুরথ জানতে পারেন সমাধির বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তার স্ত্রী ও ছেলে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সমাধিও তারই মতো স্বজন প্রতারিত ও সর্বহারা।কিণ্তু তিনিও সবসময় তার স্ত্রী ও ছেলের ভালোমন্দের কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হন। তারা ভাবলেন যারা তাদের সর্বহারা করেছে কেন তাদের কল্যাণের কথাই সবসময় মনে হয়। তারা মেধা ঋষিকে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেন এই সবই মহামায়ার ইচ্ছায়। এরপর ঋষি ,সুরথ ও সমাধিকে দেবী মহামায়ার কথা স-বিস্তারে বর্ণনা করেন। এরপর মেধাঋষির পরামর্শে রাজা সুরথ নদীর তীরে কঠিন তপস্যা করেন ।
পরে মহামায়ার উদ্দেশ্যে বসন্তকালে, চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করেছিলেন। এই দুর্গাপূজাই বাসন্তীপূজা নামে পরিচিত। বাসন্তীপূজা এখন হাতে গোনা কতকগুলো বনেদি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।তবে আজকে আমাদের সংসার জীবনে আবদ্ধ পূজা কে যেন অকাল বোধন পূজা হিসাবে মেনে নিয়েছি।মেয়েদের দুটো বাড়ি থাকে একটি শ্বশুরবাড়ি আরেকটি বাপের বাড়ি, দুর্গাদেবীর তেমনি ইতিহাস বহন করে চলেছে প্রাচীনকাল হইতে।আমরা যেমন ঘর-সংসার, স্বামীসন্তান, আত্মীয় পরিজন ছাড়া কোনও কিছু চিন্তা করতে পারি না, আমরা দুর্গার ক্ষেত্রেও তাই দেখতে চেয়েছি। লৌকিক দুর্গা আমাদের মাঝে দেখা দেন সপরিবারে। বাঙালির আপন মনের মাধুরী মেশানো দুর্গা তার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে কৈলাশ থেকে হিমালয়ের ঘরে বাপের বাড়ি আসেন।
বাঙালির ঘরে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার মতো আনন্দ। যেমন– পরিবারে সবাই আপন, সেরকম জগজ্জননীর বিশ্বসংসারে আমরা শিক্ষিত, অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী বৈশ্য, শাসনকর্তা- সবাই বিশ্বজননীর সন্তান– সরস্বতী, কার্তিক, লক্ষ্মী ও গণেশের মতো সবাই আপন। সন্তানদের কল্যাণের জন্য মা দুর্গা সর্বদাই উদগ্রীব। তাই ১০ দিক থেকে সন্তানদের রক্ষা করার জন্য তিনি ১০ হাতে ১০ অস্ত্র ধরেছেন।বর্তমান ও অতীতের মধ্যে কেমন যেন একটা সামাঞ্জস্য মেলবন্ধন রয়েছে দেবী দুর্গার ইতিকথা তে। বর্তমান বারোয়ারি বা সার্বজনীন দুর্গাপূজার যে রূপ আজকের দিনে আমরা দেখতে পাই, তা নির্মিত হয়েছে পরিবর্তনের স্রোতধারায়। বাংলায় দুর্গার ধর্মীয় উত্থান প্রভাবিত হয়েছে সমসাময়িক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্বারা। পরিবর্তনের একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায় মূর্তির রূপান্তরে।
পৃষ্ঠপোষকদের মনস্তাত্ত্বিক গঠনও এ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। অষ্টাদশ শতকের জমিদার, নায়েব ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এই পরিবর্তনের রাজনীতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। দুর্গাপূজাকে আশ্রয় করে প্রচারিত হয়েছে তৎকালীন অভিজাত হিন্দু শ্রেণির আভিজাত্য। লৌকিক দেবদেবীকে ছাপিয়ে দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছিল উচ্চ শ্রেণির আরাধনা। শাসকশ্রেণির সঙ্গে উচ্চ শ্রেণির স্বার্থসংশ্লিষ্টতাই ছিল এর প্রভাবক। তবে বর্তমানের সার্বজনীনতা একদিকে যেমন দুর্গোৎসবকে ব্রাহ্মণ্যবাদের কাঠিন্য থেকে মুক্ত করেছে, তেমনি বর্ণ-নির্বিশেষে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপনে হয়েছে সহায়ক।সেই কারনে বাংলা সাহিত্যেও দুর্গাপূজা উঠে এসেছে বিভিন্ন রচনায়। দেবী দুর্গা সেখানে কখনো মাতৃরূপে, কখনো শক্তি রূপে, আবার কখনো-বা এটিকে দেখা হয়েছে কেবল অনুষ্ঠানিকতা হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বর্তমানযুগে একদল অতিপন্ডিতের আবির্ভাব হয়েছে, যারা বেদকে ঢাল বানিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও নিজমত প্রতিষ্ঠা করতে সকল প্রকার ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান হিন্দুসমাজে বেদ তো দূরের ব্যাপার, গীতা, ভাগবতাদি গ্রন্থও অধিকাংশ লোক জানার চেষ্টা করে না; ফলে তাদের খুব সহজেই বিভ্রান্ত করে নিজ মতে দীক্ষিত করা খুব সহজ। এই শ্রেণির লোকেরা বেদকে কেন্দ্র করে নানারকম অপপ্রচার, অর্ধসত্য, অর্ধশ্লোক ও বিকৃত অর্থ করার মাধ্যমে বেদে মূর্তিপূজা নিষেধ, ঈশ্বর সাকার নন বা দুর্গা দেবীর অস্তিত্ব বেদে নেই, এমন কিছু উদ্ভট সিদ্ধান্ত প্রচার করে থাকেন।এখন আমরা দেখবো বেদে কি আসলেই দুর্গা নেই এবং দুর্গাপূজার মতো মহাপূজা হঠাৎ করেই মাঠি ফুঁড়ে বের হয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে-অর্থাৎ, অগ্নিবর্ণা তপ প্রদীপ্তা সূর্য ( বা অগ্নিস্বরূপিণী) যিনি কর্মফলের প্রার্থিত হন, সেই দুর্গাদেবীর আমি শরণাপন্ন হই, হে সুন্দররূপে, ত্রাণকারিণী, তোমাকে নমস্কার। ঋগবেদে দেবীসুক্ত যা দুর্গাপূজায় চন্ডীপাঠের পূর্বে পাঠ করা বিধি আছে, সেখানে দেবীকে পরমা প্রকৃতি, নির্বিকারা ও জগতের ধাত্রীরূপে বর্ণিত আছে।
অন্যদিকে সমস্ত দেবতার তেজ হতে দেবীদুর্গার আবির্ভাবের পর দেবী দুর্গা দেবতাদের ঋকমন্ত্রে নিজের পরিচয় দিলেন বলে দেবী পুরাণে উল্লেখিত আছে; আর সেই ঋকমন্তই হলো ঋগবেদের দেবীসুক্ত। এছাড়া বেদের রাত্রিসুক্তে কালী, শ্রীসুক্তে লক্ষ্মী এবং বাণীসুক্তে সরস্বতীর বন্দনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বেদ দেবতাদের মহিমাতে রূপ ও পূজাপদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। আর বেদকে স্বীকার করলে পুরাণকেও স্বীকার করতে হবে। কারণ, বেদ এবং বেদান্ত নিজেই পুরাণকে স্বীকার করেছে।এদিকে ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে-‘ইতিহাস ও পুরাণসমূহ হলো পঞ্চম বেদ। আবার, অথর্ববেদ বলছে ‘ইতহাসস্য চ বৈ পুরাণস্য চ….চ’। যেহেতু বেদ পুরাণকে শাস্ত্র বলে স্বীকার করেছে, তাই পুরাণ মতেই দেবী দুর্গার রূপ ও পূজাপদ্ধতি প্রণীত হয়েছে। যাহোক, আবারো আমরা বৈদিক ধারায় ফিরে আসি।
শুক্ল যর্জুবেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় অম্বিকাদেবীর সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ভদ্রকালীর, কেন উপনিষদে দেবী উমার কথা পাই যারা দেবী দুর্গারই অপর নাম।যাজ্ঞিকা উপনিষদে দুর্গার গায়ত্রী আছে- ‘কাত্যায়নার বিমতে কন্যাকুমারীং ধীমহি তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াৎ।’ এখানে দুর্গা সম্বোধনপদে দুর্গি হয়েছে। এতে কাত্যায়নী বা কন্যাকুমারী দুর্গার অপর নাম তা সকলেই জানে। এছাড়া গোপাল তাপনী উপনিষদ, নারায়ণ উপনিষদ ইত্যাদি বৈদিক গ্রন্থে দুর্গার উল্লেখ আছে।তবে সবকিছুই কেমন যেন একটা বিতর্ক সৃষ্টি করে রেখেছে, আসল সমাধান তেমনি কোনো পত্র পত্রিকাতে পাওয়া যায়নি। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে।দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছি ল।এই বিষয়ে নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের।
অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারণা। ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারণা অতি প্রাচীন। প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বে ভারতের প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত। হরপ্পা ও মহেন্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়। এই মত অনুসারে দেবী হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ। অন্যান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র।
মহাভারত অনুসারে, দুর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রূপে। অন্যদিকে হিন্দু পুরাণে আছে, ভগবান ব্রহ্মা মহিষাসুর দৈত্যের কিছু ভালো কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চেয়েছিলেন, মহিষাসুর ‘অমর’ বর প্রার্থনা করেছিল, ব্রহ্মা সরাসরি অমরত্ব বর না দিয়ে বর দিলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না। ভগবান ব্রহ্মা, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, তার কাছ থেকে এমন বর পেয়ে মহিষাসুর ধরাকে সরাজ্ঞান করতে আরম্ভ করে। সে ধরেই নিয়েছিল যেহেতু নারীরা শারীরিক দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল এবং কোনো পুরুষের হাতে তার মৃত্যু নেই, তাই সে হবে অপরাজেয়, অমর। তার খুব ইচ্ছা হলো স্বর্গ-মর্ত্য জয় করার, দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিল, তার অত্যাচারে স্বর্গের দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করে মহিষাসুরের অত্যাচার দেবতাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।
এভাবেই মহিষাসুর অপরাজেয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, এরপর সে স্বর্গের দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়ন করতে শুরু করে।অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, তারা ব্রহ্মার দেওয়া কঠিন বরের ভেতরেই আলো দেখতে পান। ব্রহ্মা বর দেওয়ার সময় বলেছিলেন, কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না, এখানে নারীর কথা উহ্য রাখা হয়েছে। তার মানে নারীর হাতে মহিষাসুরের পরাস্ত হওয়ায় কোনো বাধা নেই। তখন ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব’র আহ্বানে দশভুজা যে নারী মূর্তির আবির্ভাব হলো, তিনিই দেবী দুর্গা। যেহেতু মহাপরাক্রমশালী মহিষাসুরের সঙ্গে লড়তে হবে, দুই হাতে লড়াই করা সম্ভব নয় বলেই দেবী দুর্গাকে দশ ভুজারূপে কল্পনা করা হয়েছে। দুর্গা আবিভর্ূত হওয়ার পর দুর্গার দশ হাত মারণাস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করে দেওয়া হলো। শিব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, ইন্দ্র দিলেন তীর ধনুক, তরবারি, ঢাল, বিষধর সর্প, তীক্ষ্ন কাঁটাওয়ালা শঙ্খ, বিদ্যুৎবাহী বজ্র শক্তি এবং একটি পদ্মফুল।
দেবী দুর্গা এবং মহিষাসুরের মধ্যে দশ দিনব্যাপী মহাযুদ্ধ হয়েছিল, মহিষাসুরকে পরাস্ত করা রীতিমতো অসাধ্য হয়ে উঠেছিল, কারণ সে মায়ার খেলা জানত, দুর্গাকে বিভ্রান্ত করতে সে একেকবার একেক জন্তু-জানোয়ারের রূপ ধারণ করছিল, দেবী দুর্গার জন্য যুদ্ধ ভীষণ কঠিন হয়ে উঠে যখন অসুরের ক্ষতস্থান থেকে রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়া মাত্র সেখান থেকে একই চেহারার আরেকটি অসুর জন্ম নিচ্ছিল।এভাবে দুর্গার তরবারির কোপে রক্তাক্ত অসুরের প্রতি রক্তবিন্দু থেকে শত সহস্র অসুরের জন্ম হলো এবং দুর্গার দিকে ধেয়ে এলো। তখনই দেবী দুর্গা অন্য মূর্তি ধারণ করলেন, সে মূর্তির রূপ হলো আরও ভয়ঙ্কর, লম্বা জিভ, চার হস্ত কালী মূর্তি, যার প্রধান কাজই ছিল অসুরের রক্তবীজ মাটি স্পর্শ করার আগেই লম্বা জিভ বের করে চেটে খেয়ে ফেলা। এভাবেই রক্তবীজ থেকে অসুরের উৎপত্তি বন্ধ হয়ে গেল এবং যুদ্ধের দশম দিনে অসুর মহিষের রূপ নিয়েছিল, উপায়ান্তর না দেখে মহিষের দেহ থেকে বেরিয়ে এলো বিশালদেহী মানুষের রূপে, তখনই দেবী দুর্গার হাতের ত্রিশূল মহিষাসুরের বক্ষ্যভেদ করল। মহিষাসুরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে শান্তি ফিরে এলো। স্বর্গের দেবতারা দেবী দুর্গার নামে জয়ধ্বনি করিলেন।
এটা দেবী দুর্গার পৌরাণিক ইতিহাস স্বঘোষিত লিপিবদ্ধ রয়েছে। তবেই শারদীয়া দুর্গাপূজাকে ‘অকালবোধন’ বলা হয়। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাঁদের পূজা যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে তাই এই পূজার নাম হয় ‘অকালবোধন’। এই দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। তবে রামায়ণের প্রকৃত রচয়িতা বাল্মিকী মুনি রামায়ণে রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপূজার কোনো কিছু উল্লেখ করেননি। উপরন্তু রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
তবে এই প্রচলিত তথ্য অনুসারে স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে শরৎকালে দুর্গাপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে। হংস নারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, ‘অকালবোধন শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না।’সনাতম ধর্মের যেকোনো পূজার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃত মন্ত্রগুলো। দুর্গাপূজার মন্ত্রগুলো সাধারণত শ্রী শ্রী চণ্ডি থেকে পাঠ করা হয়। ঢাক-ঢোল, খোল করতাল, সুগন্ধি আগরবাতি আর এগুলোর সাথে সংস্কৃতমন্ত্র পবিত্র এক পরিবেশের জন্ম দেয়।সেই কারনে রামচন্দের দুর্গাপূজার কোন নির্দিষ্ট বিধান নেই। সেজন্যই হয়ত বাংলায় অকাল বোধনের কোন নির্দিষ্ট কোন “ভাব” নেই। কৃত্তিবাস ওঝার দৌলতে অবশ্য আমরা শিশুকাল থেকেই অকালবোধনের কথা শুনে এসেছি। তিনি অত্যন্ত নিপূণভাবে সবিস্তারে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বিবরণ দিয়েছেন। সে বিবরণ অনেকটা এ রকম ছিল।
অপহৃত পত্নী সীতাকে উদ্ধার প্রকল্পে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে শ্রী রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করেছিলেন। রামচন্দ্র ভ্রাতা লক্ষণ ও বিপুল সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে লংকার সকল বড় বড় বীরদের নিধন করেছেন। তখন শ্রান্ত ও বিদ্ধস্ত রাবণ একা কোনক্রমে লঙ্কপুরী রক্ষা করে চলেছেন। এমন সময় একবার হনুমানের হাতে প্রচন্ড প্রহারে রাবণ জ্ঞান হারালেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে শ্রীরাবণ তখন মাতা অম্বিকার স্তব শুরু করে দিল। রাবণের কাতর প্রার্থণায় দেবী হৈমবতীর দয়া হল। তিনি কালীরূপে আবির্ভূত হয়ে রাবণকে নিজ ক্রোড়ে নিয়ে দিলেন অভয়বার্ত্তা। শয়তান রাবণকে দেওয়া দেবী কালীর অভয়বাণী সকল দেবদেবীদের মনে ভয় ও উৎকন্ঠার সৃষ্টি করল। এই দুঃসংবাদে স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র প্রমাদ গুনলেন। বীর ইন্দ্র ব্রহ্মার কাছে গিয়ে রাবণকে দমন করার জন্য প্রার্থণা করলেন। সকলের প্রার্থণায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবাদিদেব ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে উপদেশ দিলেন – দুর্গাপূজা করো, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
শ্রীরামচন্দ্র উৎকন্ঠাসহ জানালেন – তা কেমন করে হবে, কারণ দুর্গাপূজার প্রশস্ত সময় হল বসন্তকাল, এখন হল শরৎকাল, আর শরৎকাল হল অকাল, তা ছাড়া বিধান হল অকালবোধনে নিদ্রাভঙ্গের পবিত্র সময় হলো কৃষ্ণানবমীতে। তা ছাড়া সুরথরাজা পূজা শুরু করেছিলেন প্রতিপদে, তা হলে এখন পূজা করব কি ভাবে? ব্রহ্মা বললেন, “আমি ব্রহ্মা, বিধান দিচ্ছি, শুক্লাষষ্ঠীতে বোধন করো।” শুনে রাম মহাখুশি হলেন। দেবাদিদেব ব্রহ্মার আদেশে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকালবোধনের প্রস্তুতি নিলেন। শ্রীরামচন্দ্র নিজে দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরী করে পূজা করেছিলেন। ষষ্ঠীর সন্ধায় বেল গাছের তলায় হল দেবীর বোধন। অধিবাসের সময় রাম স্বহস্তে বাঁধলেন নবপত্রিকা। শ্রীরাম চণ্ডীপাঠ করে উৎসব করলেন । এই সপ্তমীর দিন সকালে স্নান করে রাম ‘বেদবিধিমতে’ পূজা করলেন। অষ্টমীর দিনও তাই। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাম সন্ধিপূজা করলেন। দুই দিনই রাতে চণ্ডীপাঠ করা হয়েছিল।
বহুরকম বনফুল ও বনফলে পূজার আয়োজন হল। ‘তন্ত্রমন্ত্রমতে’ পূজা হল। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র দেবীর দর্শন পেলেন না। তখন বিভীষণ উপদেশ দিলেন – নীলপদ্মে পূজা করলে দেবী নিশ্চয় পরিতুষ্ট হয়ে দর্শন দেবেন। নীলপদ্ম, সে তো বড় দুর্লভ, ধরাধামে একমাত্র দেবীদহ হ্রদেই নীলপদ্ম প্রস্ফুটিত হয়, আর সে হ্রদ তো লঙ্কা থেকে বহু দূরে, এ বিপদের কথা শুনে হনুমান আর স্থির থাকতে পারলেন না, এক নিমেষে দেবীদহ হ্রদ থেকে এনে দিলেন একশত আটটি নীল পদ্ম। কিন্তু পূজার মুহূর্তে রাম দেখতে পেলেন একটি ফুল কম পরেছে, তাই তিনি তাঁর নিজের নীলপদ্মের মত একটি চক্ষুকেই নিবেদন করতে উদ্যত হলেন, তখন দেবী কাত্যায়নী শ্রীরামচন্দ্রের হস্ত ধরে বাধা দিলেন। রাবণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করার জন্যই দেবী দুর্গা ছলনা করে একটি নীল পদ্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু শ্রীরামের একাগ্রতা ও অসীম ভক্তির কাছে দেবী দুর্গার পরাজয় হলো, বাধ্য হয়ে দেবী দুর্গা শ্রীরামচন্দ্রকে রাবণ বধের বর প্রদান করলেন।
দেবী দুর্গার বর লাভ করে শ্রীরামচন্দ্র অকাল বোধনের মহাসপ্তমীতে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং মহাস্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে শ্রী রাবণকে বধ করতে সক্ষম হন। এ সময়েই অকাল বোধনের সন্ধিপূজা করা হয়ে থাকে। আর মহাদশমীর দিন রাবণকে চিরশয্যায় অর্থাৎ দাহ করা হয়েছিল। এরপর রাম দশমীপূজা সমাপ্ত করে মৃন্ময়ীদুর্গাপ্রতিমার বিসর্জন দিয়ে অকাল বোধন সমাপ্ত করেন। আরাধ্য দেবী শক্তি, মহাশক্তি, দশোভূজা শিবানী ইতিহাস এখানে শেষ নয়। তথাকথিত ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে।দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুমারী পূজা। দেবী পুরাণে কুমারী পূজার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্র অনুসারে সাধারণত ১ বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজার উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মণ অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে। এদিন নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। দেবীর মত সাজিয়ে হাতে দেওয়া হয় ফুল, কপালে সিঁদুরের তিলক এবং পায়ে আলতা। সঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। চারদিক শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মায়ের স্তব-স্তুতিতে পূজাঙ্গণ মুখরিত থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘শুদ্ধাত্মা কুমারীতে দেবী বেশি প্রকাশ পায়।
কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী জাতি হয়ে উঠবে পূত-পবিত্র ও মাতৃভাবাপন্ন, শ্রদ্ধাশীল।’১৯০১ সালে ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুড় মঠে ৯ জন কুমারী পূজার মাধ্যমে এর পুনঃপ্রচলন করেন। হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, চিরবিধবাসহ নানা অবিচারে নারীরা ছিল নিপীড়িত। চিরকুমার বিবেকানন্দ নারীকে দেবীর আসনে সম্মানিত করার জন্যেই হয়তো পুনঃপ্রচলন করেন। ১৯০১ সালের পর প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে। আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কল্যাণ সাধনই কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য। দুর্গাপূজা আদি পুজো হিসাবে ঘোষিত রয়েছে, আরও একটি অংশ সন্ধিপূজা। অষ্টমী দিনের শেষে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় দেবী দুর্গাকে চামুণ্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। তান্ত্রিক মতে এই পূজা সম্পন্ন হয়। এই পূজায় দেবীকে ষোলটি উপাচার নিবেদন করা হয়। দেবীর উদ্দেশে হয় পশুবলি; সেই বলিকৃত পশুর মাংস ও রক্ত এবং মদ দেবীকে দেওয়া হয়।
এককভাবে চামুণ্ডা, চণ্ডি বা কালী পূজায় পশুবলি দেখা গেলেও বাংলাদেশের কোথাও দুর্গাপূজায় পশুবলি হয় না।কেন বলি হয়, কেন হয় না? তা নিয়ে এই লেখার মধ্যে বিস্তারিতভাবে আলোচনা সরূপ লিপিবদ্ধ করেছি।সরকারি বা জাতীয়ভাবে এই উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হিসাবে অভিহিত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাকে শরৎকালের বার্ষিক মহোৎসব হিসাবে ধরা হয় বলে এই পূজাকে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। রামায়ন অনুসারে, অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে শরৎকালের দুর্গা উৎসবকে অকালবোধনও বলা হয়। বসন্তকালের দুর্গাপূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। এসব যাই হোক না কেন পূজার মন্ত্র না উল্লেখ এই লেখাটি সম্পূর্ন হবে না।
দুর্গা পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার মন্ত্র: ঔঁ জয়ন্তি মঙ্গলা কালী, ভদ্র কালী কপালিনী, দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী, স্বাহা স্বধা নমস্তুতে। এস স্ব চন্দন পুষ্প বিল্ব পত্রাঞ্জলী নম ভগবতী দুর্গা দেবী নমহ্।এদিকে প্রণাম মন্ত্র: সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে।তবে আমরা সর্বদাই নম্রতা সাথে এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকি, দেবী দুর্গার পাদদেশে বসে। উচ্চারণ মন্ত্র যোগসুত্র পাওয়া যায় মধ্যযুগেও।মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। ১১শ বা ১২শ শতক থেকে এখানে কালীপূজার সাথে দুর্গাপূজাও হত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে।যতটুকু জানা যায়, কারও মতে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দুর্গাপূজা করেন। আবার কারও মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংশ নারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।
অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গাপূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার সুবর্ণ রায় চৌধুরী সপরিবারে দুর্গাপূজা চালু করেন। ১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী রংপুরের শারদীয় পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার আক্রমণে কলকাতার একমাত্র চার্চ ধ্বংস হবার পর সেখানে কোনো উৎসব আয়োজনের অবস্থা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নব কৃঞ্চদেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে দুর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন।আধুনিক দুর্গাপূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ শতকে নানা বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসাযী, রাজদরবারের রাজ কর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে দুর্গাপূজা হতো। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দুর্গাপূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। ওরিষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। বর্তমানে দুর্গাপূজা দুইভাবে হয়ে থাকে- ব্যক্তিভাবে, পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে; পাড়াস্তরে বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত।তবে সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী অবদি পাঁচদিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে আখ্যাত হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত।
অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়; এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি।এতে দিনকার এ ইতিহাসে দেখা দিলো মতান্তর। সম্প্রতি ইতিহাস পর্যালোচনা করে কয়েকজন বিশ্লেষক অভিমত দিয়েছেন : কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু দিকে। কিন্তু তারও আগেকার সাহিত্যে ও অন্যান্য সূত্রে বাংলায় দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। খুব সম্ভবত, যে বিপুল ব্যয়ে কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেন, তাই সেই যুগের জনমানসে দুর্গাপূজার সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিল। আর সেই থেকেই কংসনারায়ণী মিথের উৎপত্তি।
এ কথা সত্যি যে দুর্গাপূজার ইতিহাস একেবারেই অর্বাচীন নয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন, ‘দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর, তন্ত্র দ্বারা সমাচ্ছন্ন।’ তাঁর মতে, বৈদিক যুগে প্রত্যেক ঋতুর প্রারম্ভে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো। শরৎঋতুর আরম্ভেও হতো। এই শরৎকালীন যজ্ঞই রূপান্তরিত হয়ে দুর্গাপূজা হয়েছে।’ তিনি বলেন, বৈদিক যজ্ঞ ও দুর্গাপূজার মধ্যে অনেক প্রভেদ রয়েছে। কিন্তু উভয়ের উদ্দেশ্য একই। বৈদিক যজ্ঞের উদ্দেশ্য, ধন-ধান্য-পুত্র, রোগমুক্তি ও শক্তিনাশের শক্তি প্রার্থনা। দুর্গার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র বলে, ‘আয়ুরারোগ্যং বিজয়ং দেহি দেবি নমস্তুতে। রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতি দেহি মে। পুত্রান দেহি ধনং দেহি সর্ব্বকামাংশ্চ দেহি মে॥’ (হে ভগবতী, আপনাকে প্রণাম করি, আপনি আমাকে রোগমুক্ত করুন, বিজয়ী করুন, যশ ও সৌভাগ্য প্রদান করুন, পুত্র ও ধন দিন এবং আমার সকল কামনা পূর্ণ করুন)। যোগেশচন্দ্র আরো দেখাচ্ছেন, দুর্গাপূজার মন্ত্রে ‘যজ্ঞ’ শব্দটির পরিব্যাপ্তি কতটা।
বৈদিক হিন্দুধর্ম ছিল যজ্ঞসর্বস্ব। দুর্গাপূজাতেও দেখি, দেবীকে যজ্ঞভাগ গ্রহণে আহ্বান জানানো হচ্ছে (‘দেবি যজ্ঞভাগান্ গৃহাণ’) এবং পশুবলি দেওয়ার সময় বলা হচ্ছে, যজ্ঞের নিমিত্তই পশুর সৃষ্টি (‘যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্টাঃ তস্মিন্ যজ্ঞে বধোহ্বধঃ’)। যোগেশচন্দ্রের তাই অনুমান, বৈদিক শারদ যজ্ঞই তন্ত্রের প্রভাবে পর্যবসিত হয়েছে আধুনিক দুর্গোৎসবে। হৃদয়ে যা জাগে, শরৎমেঘে তাই তো দেখা যায়। বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা।এই মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে (রচনাকাল আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী)। এ ছাড়া দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণ (মূল পুরাণটি চতুর্থ শতাব্দীর রচনা, তবে দুর্গাপূজার বিবরণ-সংবলিত সপ্তশতী চণ্ডী অংশটি পরবর্তীকালের সংযোজন), বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ (সঠিক রচনাকাল অজ্ঞাত), কালিকা পুরাণ (রচনাকাল নবম-দশম শতাব্দী) ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণে (রচনাকাল ১২০০ শতাব্দী)।
নবম-দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃতও হয়েছে। দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব অনুধাবনে আরো একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রঘুনন্দনের (১৫৪০-১৫৭৫) ‘দুর্গাপূজা তত্ত্ব’ গ্রন্থটি। নবদ্বীপের এই স্মার্ত পণ্ডিতের লেখা গ্রন্থটিতে দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান রয়েছে। এই সব বিধান তিনি নিজে সৃষ্টি করেননি। বরং আগের পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে পূজাপদ্ধতি লিখেছেন। কোনো কোনো বিধানের পৌরাণিক প্রমাণ দিতে পারেননি। একে তিনি বলেছেন আচার, দেশাচার বা কুলাচার। আচার তাকেই বলে যা, দেশে বা বংশে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। স্মৃতিশাস্ত্রের ধর্ম যা কিছু পুরনো, সে পৌরাণিকই হোক আর আচারগতই হোক, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নতুনকে বাতিল করা।
স্মার্ত রঘুনন্দনের দেওয়া স্বীকৃতি দেখলে মনে হয়, দুর্গাপূজার যাবতীয় রীতিনীতি বহু বছর আগে থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল। সম্ভবত, প্রাচীন দুর্গাপূজাকে রঘুনন্দন তাঁর গ্রন্থের মাধ্যমে একটি সুসংবদ্ধ রূপ দিয়েছিলেন। সেই কীর্তিই নতুন করে এই পূজার প্রতি বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কালক্রমে ঘটনাচক্রে তা বাঙালি হিন্দুর জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে একটি তথ্য দিয়ে রাখি, কংসনারায়ণের বংশে প্রথম দুর্গাপূজার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা উদয় নারায়ণ।সেটা ছিল ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। রঘুনন্দন তখন বাঙালি হিন্দুসমাজের অন্যতম প্রতীক।
যাক এসব কথা, এই লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কথা বলে লেখাটি শেষ করতে চাই।বিবেক জাগ্রত না হলে বিশ্ব মানবতার সন্তান হয়ে ওঠার যোগ্যতা লাভ করা যায় না। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ‘বোধন মানে বোধসূত্র, যাকে আশ্রয় করে অন্তরে বাহিরের যা কিছুকে বুঝে সুঝে চলতে পারা যায়। ’পূজা মানেই তো সংবর্ধনা অর্থাৎ যার পূজা করি তাঁর মহনীয় গুণাবলীকে সুনিষ্ট অনুশীলনের দ্বারা নিজেকে চরিত্রগত করে তোলা এবং ধীরে ধীরে তা বাড়িয়ে তোলা।
বলি হলো উৎসর্গ। আমাদের নিজেদের হিংস্রতা ও লালসাকে পোষণ করতে যেয়ে এরকম নিষ্ঠুরভাবে পশুহত্যা আমরা ক্রমাগত করে চলছি। তাতে পূজার উদ্দেশ্য কতখানি সিদ্ধ হচ্ছে? মন কতটা ভাগবৎমুখী হয়ে উঠছে? পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকের ওপর দরদী হয়ে ওঠার এই ক্রিয়া কতটা সহায়তা করছে? ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের কতটা তীক্ষ্ণ ও তরতরে হয়ে উঠছে? কোনোটিই হচ্ছে না। কারণ, আমরা বলি শব্দের প্রকৃত অর্থ জানি না। তাই বলিদানও হয় না। বলি শব্দ এসেছে বল্ ধাতু থেকে, মানে বর্দ্ধন। মায়ের পূজা যে বলি হয় তার মানে বেড়ে ওঠা বা বলীয়ান করে তোলা। মায়ের পূজা করে মানুষ সংবধিক হয়ে ওঠে।
বিসর্জন শব্দটি বি-সৃজ ধাতু থেকে উৎপন্ন, বিশেষ প্রকারে সৃষ্টি করা। যে মাতৃপূজা করলাম, সেই মায়ের সর্ব মঙ্গলকারিণী স্নেহসুন্দরভাবে ও চরিত্রকে নিজের অন্তরে বিশেষভাবে সৃষ্ট, অর্থাৎ দৃঢ়নিবন্ধ করে তোলা চাই। মায়ের সেবায় আমাদের বৃত্তিগুলোকে নিয়োজিত করি, তখনই হয় বিসর্জনের স্বার্থকতা।মা দুর্গা সাধারণের কাছে দেবী দুর্গা, মহাময়া, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, শ্রী চন্ডী প্রভৃতি নামে পরিচিত। সর্বশক্তি স্বরূপিনী আদ্যাশক্তি হলেন এই মা দুর্গা।
তাঁর দুর্গা নামটির মধ্যেই অসুর শক্তি নাশের পরিচয়। তিনি দুর্গ নামের এক দৈত্যকে বধ করে দুর্গা নামে খ্যাত হন। যুগে যুগে দেবতাদের কল্যাণের জন্য দেবী দুর্গা অত্যাচারী ভোগলোলুপ অসুরদের নিধন করেছিলেন। মা দুর্গা শত্রু বিনাশে যেমন ভয়ঙ্করী আবার ভক্ত বা সন্তানের কাছে তিনি তেমনি স্নেহময়ী জননী, কল্যাণ প্রদায়িনী। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে বাঁ হাত করে শঙ্কা হরণ। দুই নয়নে স্নেহের হাসি ললাট নেত্র আগুণবরণ।