বিচিত্রতা

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ - West Bengal News 24
ছবি রোড অব বোনস

জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন সময় পৃথিবী সাক্ষী হয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট নানা যুদ্ধের। সবটাই ছিল ক্ষমতার লড়াই। ক্ষমতার জন্যই মানুষ লিপ্ত হত ধ্বংসলীলায়। তবে এক শতাব্দীতেই পৃথিবী দেখেছিল দুইটি যুদ্ধ। যা আসলে একটি বা দুটি দেশ বা জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পুরো পৃথিবীতেই এর আঁচ পড়েছিল। বলছিলাম প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা।

১৯ শতকের শুরুর দিকেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। চার বছর ছিল যার স্থায়ীত্বকাল। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, হয়েছে সর্বহারা। প্রিয়জন হারানোর শোক কাটতে না কাটতেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখনই পৃথিবীর বাতাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বারুদের গন্ধ আর কালো ধোঁয়া মুছে যায়নি। ক্ষমতার লড়াই সীমাবদ্ধ থাকেনি রাজাদের মধ্যে। যুদ্ধের বিষবাতাস ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বেই।

আরও পড়ুন: আস্ত সাপকে গিলে খাচ্ছে অন্য একটি বিষধর সাপ, ভিডিও ভাইরাল নেট দুনিয়ায়

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ - West Bengal News 24
রাস্তা তৈরির কাজ করছেন বন্দিরা

এই সময় অনেক দেশ এবং শহর হয়েছে নিশ্চিহ্ন। নিরাপরাধ মানুষগুলো জীবন দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য। তেমনই ভলগার তীরঘেঁষা ঐতিহাসিক স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের কথা তো সবাই জানেন। যা থামিয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয় তথা বিশ্বসভ্যতার পতন। ৭৫ বছর আগে ১৯৪৩ সালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী প্রায় পুরো ইউরোপ দখল করে। তারও আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের ককেশাস অঞ্চল দিয়ে এগিয়ে মস্কো দখলের অভিপ্রায়ে স্তালিনগ্রাদ শহরকে কবজায় আনতে চেয়েছিল।

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ - West Bengal News 24
রাস্তা তৈরির সময় কেউ মারা গেলে সেখানেই তাকে মাটি চাপা দেয়া হত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধই ছিল চূড়ান্ত যুদ্ধ। সাড়ে ছয় মাস ধরে স্তালিনগ্রাদ শহর ঘিরে চলা এই যুদ্ধ ছিল নৃশংস আর ভয়াবহ। স্তালিনগ্রাদ পতনের পরই নাৎসি বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। এর আরো দুই বছর পর ১৯৪৫ সালে ফ্যাসিস্ট জার্মানির কবর রচনার শুরুটাই ছিল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ।

আরও পড়ুন: ভোট দিতে গিয়ে লটারি জিতে কোটিপতি

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ - West Bengal News 24
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধই ছিল চূড়ান্ত যুদ্ধ

সেই সময়কার ভয়াবহ আর নারকীয় হত্যার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক শহর। তেমনি রাশিয়ার উত্তর পূর্বে সাইবেরিয়ার ইয়াকুটস্কের নিকটবর্তী এক হাইওয়ের যেখানে সেখানে মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। কোথাও মাথার খুলি, কোথাও বা হাত-পা বা শরীরের অন্য অংশের হাড়ের টুকরো প্রায় গোটা রাস্তাতেই ছড়িয়ে রয়েছে।

এই রকম মানব-অস্থি ছড়ানো পথের নাম হয়েছে ‘রোড অব বোনস’। অবশ্য এর একটি পোশাকি নামও রয়েছে কোলাইমা হাইওয়ে। স্তালিন জামানায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে এই হাইওয়ে নির্মিত হয়েছিল। জানা যায়, এই রাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল সেভভোস্তলাগ লেবার ক্যাম্পের বন্দিদের শ্রমে ঘামে। ১৯৩২ সালে এই রাজপথের সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয় যা ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তা চলে। আর এতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল গুলাগ বা বন্দিশিবিরের আবাসিকদের শ্রম।

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ - West Bengal News 24
বন্দিদের শ্রমে ঘামে তৈরি হয় এই রাস্তা

আরও পড়ুন: নগ্ন ছবিতে পোপের লাইক, মডেল বললেন স্বর্গে যাবো

অনুমান করা হয়, এই পথ তৈরি করতে গিয়ে বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন। তাদের হাড়গোড় এই রাস্তার নীচেই চাপা পড়ে যায়। মূলত যারা কাজ করার সময় মারা যেতেন তাদের রাস্তায়ই মাটি চাপা দেয়া হত। গ্রীষ্মে এই অঞ্চলটি আর্দ্র এবং অস্বাস্থ্যকর। শীতকালে অসম্ভব ঠান্ডার কারণেও এখানে তেমন ভাবে মানব বসতি গড়ে তোলা যায়নি। এই দুর্গম জায়গাতেই গুলাগে আটক মানুষদের দিয়ে তৈরি করা হয় এই হাইওয়ে। সেই কারণে এই রাজপথ আজ সোভিয়েত জমানার এক লজ্জাজনক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিবেচিত।

স্তালিন জমানার গুলাগে আটক মানুষের জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মারক এই পথ আজ যেন এক জীবন্ত মিউজিয়াম। কোলাইমা অঞ্চলের গুলাগে বন্দি ছিলেন কবি ভারলাম শালামভ। মুক্তি পাওয়ার ১৫ বছর পরে তিনি সেই বন্দিজীবনের স্মৃতিকথা ধরে রাখেন ‘কোলাইমা টেলস’ নামক গ্রন্থে। এই গুলাগে ৩ সপ্তাহ বাস করলে অতিরিক্ত পরিশ্রম, ঠান্ডা, খিদে এবং প্রহরীদের নির্যাতনে মানুষ পশুতে পর্যবসিত হয়।

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ - West Bengal News 24
এমন অনেক মানুষের হাড় ছড়িয়ে আছে এখনো এই পথে

স্তালিন জামানা অতিক্রান্ত হলে গুলাগের জ্বলন্ত স্মৃতির উপরে প্রলেপ দিতে প্রচার করা হতে থাকে সোভিয়েত রাশিয়ার সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার কিংবদন্তি। কোলাইমা-সহ বহু গুলাগের এক সময়ের বন্দিরাও সেটা মেনে নেন। কোলাইমার গুলাগে বন্দিদের অনেক সময়েই নিকটবর্তী টিন বা অন্যান্য খনিতে কাজ করতে বাধ্য করা হত। অতিরিক্ত শ্রমে, ঠান্ডায়, কম আহারে পোকামাকড়ের মতো মারা যেতেন তারা। তাদের অনেকের দেহাবশেষই আজ ‘রোড অব বোন’-এর নীচে বলে অনুমান করা হয়।

আজও রাশিয়ায় এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা স্তালিনকে ‘দেবতা’ বলে মানেন। তাদের মতে, যে নির্যাতন সাধারণের উপরে হয়েছে, তার জন্য দায়ী পার্টি ও দলের নেতারা। শালামভের স্মৃতিকথাকেও অনেকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। আজকের স্তালিনভক্তরা তাকে আগাগোড়া কল্পিত বলে দাবি করেন। গুলাগের স্মৃতি ধরা রয়েছে আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিনের মতো সাহিত্যিকের রচনাতেও। সুতরাং গুলাগের ভয়াবহতাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ - West Bengal News 24
ঠান্ডা ক্ষুধা সেই সঙ্গে হাড়ভাঙ্গা খাটুনিই ছিল বন্দিদের মৃত্যুর কারণ

রাশিয়ার উত্তর পূর্বের শহর মাগাডানের সঙ্গে লেনা নদীর তীরে নিঝনি বেস্টিয়াখ শহরকে সংযুক্ত করেছে ‘রোড অব বোনস’। গুলাগের ভয়াবহতাকে গণস্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য মাগাডানে রয়েছে একটি গুলাগ মিউজিয়াম। ১৯৯০ সালের দশকে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের আমলে ‘রোড অব বোনস’এর মুখেই তৈরি করা হয় ‘মাস্ক অব সরো’ নামের একটি কংক্রিট ভাস্কর্য। কোলাইমার অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতের স্মারক এই ভাস্কর্য।

আরও পড়ুন : চাকরি ছেড়ে ২০১৬ সালে ১২ হাজার টাকায় ব্যবসা শুরু, আজ এই নারী কোটিপতি

বন্দিদের শরীরের হাড় দিয়েই তৈরি হয় এই শহরের পথ - West Bengal News 24

সম্প্রতি আবার গুলাগের ভয়াবহতাকে উস্কে দিয়েছে ‘রোড অব বোনস’থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু নরকঙ্কাল। অনুমান, ১৯১৭-১৯২২ সালের রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে মৃত ব্যক্তিদের কঙ্কাল সেগুলি। অর্থাৎ শুধু গুলাগের দুঃখজনক স্মৃতি নয়, এই অঞ্চলের মাটির নীচে রয়ে গিয়েছে রুশ ইতিহাসের আর এক রক্তক্ষয়ী সময়ের ইতিহাসও।

সব মিলিয়ে, ‘রোড অব বোনস’ সোভিয়েত নির্যাতনের এক বহমান স্মারক। আর সাম্প্রতিক আবিষ্কার তার সঙ্গে যোগ করল বলশেভিক রাজ প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকের এক রক্তাক্ত অধ্যায়কেও। রাজতন্ত্রবাদী, বিদেশি শক্তি এবং সমরনায়কদের যৌথশক্তির সঙ্গে বলশেভিকদের লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত শুয়ে রয়েছে ‘রোড অব বোনস’-এর গভীরে।

আরও পড়ুন ::

Back to top button

দয়া করে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের অনুমতি দিন

দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনও বিজ্ঞাপন ব্লকার ব্যবহার করছেন। আমরা বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা করি ওয়েবসাইটের ফান্ডের জন্য